বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা:‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে, স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে, ড্রয়িং রুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দি।’ আজও এই গানে বুঁদ হয়ে থাকে আপামর বাঙালি। বাঙালির চিরকালীন সুরের যে গণ্ডি, সেই চেনা ছকের বাইরে গিয়ে নতুন এক ধারার জন্ম দিয়েছিল এই গান। আর যাঁদের গলা আর বাদ্যযন্ত্রের জাদু এই গানকে অমর করে দিয়েছিল, তাঁরা একসঙ্গে লুকিয়ে ছিলেন একটি ব্যান্ডের নামের আড়ালে। হ্যাঁ, সেই ব্যান্ডের নাম ছিল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’।
সেই ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রঞ্জন ঘোষাল চলে গেলেন। বাংলা সঙ্গীতজগতের দিনবদলের অন্যতম সাক্ষী ছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার ভোর রাতে বেঙ্গালুরুতে নিজের বাড়িতেই ঘুমের মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। স্বভাবতই শোকের ছায়া বাংলা সঙ্গীত জগতে। বাংলা রকে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। একই সঙ্গে বেপরোয়া জীবনযাপন ও বর্ণময় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাঁকে বিপুল জনপ্রিয়তা দিয়েছিল। তাঁর জন্ম বর্ধমানের মেমারিতে। বাবা ছিলেন দুঁদে গোয়েন্দা। তিনি রেখে গেলেন স্ত্রী সঙ্গীতা ঘোষাল ও দুই পুত্রকে।
রঞ্জন ছিলেন একাধারে কবি, সুরকার, নাট্যকার। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে স্নাতক হওয়ার পরই রঞ্জন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে জড়িয়ে পড়েন। পরে মুম্বইয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে শিল্প ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পিএইচডি করেন। গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের প্ৰথম ব্যান্ড ‘সপ্তর্ষি’র অন্যতম সদস্য ছিলেন রঞ্জন। তখন তাঁরা সকলে মিলে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে সংকীর্তন গাইতেন। হাতে থাকত চেলো, গিটার, ডুগডুগি। ১৯৭৫ সালে ভারতের প্রথম বাংলা স্বাধীন রক ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ যখন তৈরি হচ্ছে, রঞ্জন তখন উপস্থাপক হিসেবে সেই দলে যোগ দেন। ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ নামটি নির্বাচন করেছিলেন তিনিই। জীবনানন্দের ‘সাতটি তারার তিমির’ কবিতা থেকেই রঞ্জন নামটি বেছে নিয়েছিলেন। ব্যান্ডের অন্য সদস্যরা ছিলেন তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, তাপস দাস, আব্রাহাম মজুমদার, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।
মহীনের গানগুলির সেই পরিচিত আওয়াজ এখন আর শোনা যায় না। ১৯৯৯ সালে গৌতম চট্টোপাধ্যায় মারা যাওয়ার পরেই ভেঙে যায় বাংলার প্রথম ব্যান্ডের মেরুদণ্ড। মহীনের প্রথম অ্যালবাম ছিল ‘সংবিগ্ন পাখিকুল’। সেখানে যে গানগুলি ছিল, সেগুলির মধ্যে ‘ভেসে আসে কলকাতা’, ‘সংবিগ্ন পাখিকুল’, ‘মেরুন সন্ধ্যালোক’ রঞ্জন ঘোষালেরই লেখা। পরে ব্যান্ডের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার ক্ষেত্রে রঞ্জনই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেই পথ ধরেই বেঙ্গালুরুতে করেন রক কনসার্ট। নাম ‘রিমেম্বারিং মহীনের ঘোড়াগুলি’। কলকাতায়ও করেছেন আরও একটি কনসার্ট ‘আবার বছর ত্রিশ পরে’। দুটি কনসার্টই ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। বেঙ্গালুরুতে দীর্ঘদিন থিয়েটারও করেছেন। স্ত্রী সঙ্গীতার সঙ্গে যৌথ ভাবে গিরিশ কর্নাডের হায়ভাদান, অরুণ মুখোপাধ্যায়ের মারীচ দ্য লেজেন্ডের মতো নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। বেপরোয়া জীবনযাপন, বর্ণময় চরিত্র রঞ্জনকে বিপুল জনপ্রিয়তা দিয়েছিল। আজ সেই বেপরোয়া রঞ্জন চিরদিনের মতো স্তব্ধ হয়ে গেলেন।